আমার শৈশব-কৈশোরের বিস্ময়কর ঘোর লাগা বয়েসটা আমি উদযাপন ও অতিক্রম করেছি পুরান ঢাকায়। জন্ম গোপীবাগ থার্ড লেনে হলেও কিছুকাল পরেই মাইগ্রেট করেছিলাম ওয়ারি হেয়ার স্ট্রিটে। অতঃপর পুরান ঢাকার অভিজাত এলাকা হিশেবে খ্যাত ওয়ারিতেই আমার বিকশিত হওয়া। এবং ক্রমশঃ মুগ্ধ কিশোর থেকে উৎসুক কৌতুহলী তরুণ হয়ে ওঠা। কৈশোর থেকে তারুণ্যে প্রবেশের এই সময়টা খুবই বিদঘুটে এবং বিপজ্জনক। এই সময়টাতেই মানুষের সঙ্গে পরিচয় ঘটে ভুল মানুষের। ভুল পরিবেশের। ভুল ঘটনার। ভুল পরিস্থিতির। ভুল খানাখাদ্যের এবং ভুল রাস্তাঘাটের।

কিন্তু আমার সিক্সথ্‌ সেন্স ছিলো খুবই প্রখর।

অতি শৈশবেই আমি ভুল মানুষ কিংবা ভুল জায়গা কিংবা ভুল মত-পথ এবং খানাখাদ্য বিষয়ে টের পেয়ে যেতাম। যে কারণে সামান্য কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া খুব একটা ভুলচুকের সঙ্গে আমার সখ্য গড়ে ওঠেনি। একমাত্র খানাখাদ্যের ব্যাপারেই আমি ছিলাম সমস্ত হিশেব নিকেশের ঊর্ধে। এই একটি বিষয়ে আমার কখনোই কোনো প্রেজুডিস ছিলো না। এখনও নেই। আমি খেতে ভালোবাসি। প্রিয় যে কোনো খাবারের সন্ধানে আমি এক শহর থেকে অন্য শহরে কিংবা এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে সদা প্রস্তুত।

শৈশবে পুরান ঢাকার ঐতিহ্য হিশেবে প্রতিষ্ঠিত বেশ কিছু খাবার আমার প্রিয় ছিলো খুব। যেমন ডালপুরি। এখনও এই কানাডায় বসেও আমি ডালপুরি খাওয়ার জন্যে মুখিয়ে থাকি। বলতে গেলে নিয়মিত আমার খাদ্য তালিকায় ডালপুরি থাকে।

ছেলেবেলায় বনগ্রাম, যোগীনগর, বিসিসি রোড, ঠাটারি বাজার, বংশাল, টিপু সুলতান রোড, ইংলিশ রোড, হাটখোলা, টিকাটুলি, রামকৃষ্ণ মিশন রোডসহ আমাদের মহল্লার নানান চিপাগলির ভেতরে বিখ্যাত অখ্যাত এবং অনামা রেস্টুরেন্টগুলোতে ডালপুরির সঙ্গে আরেকটা মজার আইটেম থাকতোই থাকতো, সেটার নাম ছিলো গোলগুল্লা। ডালপুরি আর গোলগুল্লা ছিলো বলতে গেলে মায়ের পেটের খালাতো ভাই টাইপের। একটার পাশে আরেকটা না থাকলে কী রকম অসম্পূর্ণ অসম্পূর্ণ ঠেকতো। হালকা ঝাল ডালপুরির পাশাপাশি হালকা মিষ্টি গোলগুল্লাও ছিলো অসম্ভব জনপ্রিয় একটা খাবার। চায়ের সঙ্গে টা হিশেবে ডালপুরি আর গোলগুল্লার কোনো বিকল্প ছিলো না।

খুবই শাদামাটা ইনগ্রিডিয়েন্টস দিয়ে তৈরি হতো গোলগুল্লা। আটার সঙ্গে অল্প চিনি এবং কিছু বেকিং পাউডার ঠিকমতো গুলে নিয়ে বিশাল কড়াইতে ডুবো তেলে ভাজতে হতো। আটার গোলা এক হাতে খাবলা দিয়ে তুলে তুলে ছুঁড়ে ফেলা হতো টগবগিয়ে ফুটতে থাকা কড়াইয়ের তেলে। কিছুটা গোলাকৃতি দেয়ার চেষ্টা থাকতো কারিগরের। ডালপুরি কিংবা গোলগুল্লার নির্মাতাদের বলা হতো কারিগর। কিন্তু একেবারে গোল শেপের হতেই হবে এমন কোনো বিধান ছিলো না। যে কারণে গোলগুল্লার চেহারা হতো কিছুটা এবড়ো খেবড়ো। কিছুটা টুব্বুস ধরণের। শরীরের এদিকে ওদিকে কখনো সামান্য টোপলা বেরিয়ে যাওয়া। ভাজাটা একটু কড়া হলে গোলগুল্লার কোনো কোনো কর্ণার কিংবা টোপলা যেতো ফেটে। তাতে করে ওই অংশটা হয়ে উঠতো একটু বেশি রকম ক্রাঞ্চি বা মুচমুচে। গোলগুল্লা খাওয়ার সময় আমি প্রথমেই কামড় বসাতাম ওই মুচমুচে অংশটাতেই!

আচ্ছা মজার এই খাবারটার নাম গোলগুল্লা কী করে হলো? আমার মনে হয় প্রথমে এটার নাম হয়তো ছিলো গোলগোলা। গোলাকার একটা গোলা থেকে গোলগোলা। তারপর গোলগোলা থেকে হয়েছে গোলগুল্লা। আবার কেউ কেউ বলতো গুলগুল্লা! আমি ওকে গোলগুল্লাই বলতাম ছেলেবেলায়।

ছেলেবেলায় গোলগুল্লার রেসিপিতে ক্রমে ক্রমে সামান্য পরিবর্তন হতেও দেখেছিলাম। প্রথমে ছিলো শুধুই আটার গোলা আর চিনি। কিছুকাল পরে তার সঙ্গে যুক্ত হলো মৌরি(গুয়ামুড়ি?)। এরপর সেখানে যুক্ত হলো নারকেলের ক্ষুদে ক্ষুদে কিউব। এভাবে গোলগুল্লাকে অভিজাত বানানো বা জাতে তোলার চেষ্টা করা হলেও আমার বরাবরই প্রিয় ছিলো অরিজিনাল অর্থাৎ প্রথম ভার্সনটা।

ঢাকায় এখন আর গোলগুল্লা দেখি না।

ঢাকার অলিগলির বহু হোটেল রেস্টুরেন্টে খোঁজ করে দেখেছি–নেই। ডালপুরি আছে বহাল তবিয়তেই কিন্তু গোলগুল্লারা পলাতক।

গোলগুল্লা যুগের কি অবসান ঘটেছে?
প্রিয় গোলগুল্লা, এককালে তোকে খুব ভালোবাসতাম। এখনও ভুলিনি তোকে।

কোথায় হারিয়ে গেলি ভাই!…

অটোয়া ১৭ মে ২০১৮